ইসলামে মানুষ হত্যার অপরাধ ও বিধান
পৃথিবীর মধ্যে অপরাধের সর্বোচ্চটা হচ্ছে মানুষ হত্যা বা খুন। মানুষ হত্যা জঘন্যতম ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এর শুরুটা হয় নারীকেন্দ্রিক। কাবিল হাবিলকে খুনের মধ্য দিয়ে মানবহত্যার ইতিহাস শুরু হয়। হাদিসে এসেছে—
‘কোনো মানুষ অত্যাচারবশত হত্যা হলে তার রক্তের কিয়দংশ আদমের (আ.) প্রথম সন্তানের ওপর বর্তাবে। কারণ, তিনিই প্রথম মানবসমাজে হত্যাকাণ্ড চালু করেন (বোখারি ৩৩৩৫; মুসলিম ১৬৭৭)।
তাই প্রায় প্রতিটি খুনের পেছনে নারী বা সম্পদের হাত খুঁজে পাওয়া যায়। আজকাল তো মানুষ হত্যা পান্তাভাতের মতো হয়ে গেছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হয়। হত্যাকারী ভাবে না যে তাকেও একদিন মরতে হবে। আর কোনো হত্যার রহস্যই গোপন থাকে না।
ইসলামে হত্যা নিষিদ্ধ
ইসলামে সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার মর্মবাণী ঘোষণা দিয়ে বিদায় হজের ভাষণে বললেন, ‘তোমাদের রক্ত তথা জীবন ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম। যেমন আজকের এই দিনে, এই মাসে ও এই শহরে অন্যের জানমালের ক্ষতিসাধন করা তোমাদের ওপর হারাম।’
কোনো মুসলিমকে গালি দেওয়া আল্লাহর অবাধ্যতা এবং তাকে হত্যা করা কুফরি। (বুখারি ৪৮; মুসলিম ৬৪)
মানবহত্যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কতটা ভয়ানকভাবে উপস্থাপন করেছেন তা একটি আয়াতে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ বলেন, ‘কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল (সুরা মাইদা, ৩২)।’
এর অর্থ হচ্ছে, দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে অন্য মানুষের প্রতি মর্যাদাবোধ যদি জাগ্রত থাকে এবং তাদের প্রত্যেকে অন্যের জীবনের স্থায়িত্বে ও সংরক্ষণে সাহায্যকারী হওয়ার মনোভাব পোষণ করে তাহলেই কেবল মানবজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিত ও নিরাপদ হতে পারে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে শুধু ওই ব্যক্তির ওপর জুলুম করে না বরং সে এ কথাও প্রমাণ করে যে, তার অন্তরে মানুষের জীবনের প্রতি মর্যাদাবোধ ও সহানুভূতির কোনো স্থান নেই। কাজেই সে সমগ্র মানবতার শত্রু। কারণ, তার মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব বিরাজমান যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে পাওয়া গেলে সারা দুনিয়া থেকে মানবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষের জীবন রক্ষায় সাহায্য করে সে আসলে মানবতার সাহায্যকারী ও সমর্থক। কারণ তার মধ্যে এমন গুণ পাওয়া যায়, যার ওপর মানবতার অস্তিত্ব নির্ভরশীল।
মানবহত্যার বিচার ও শাস্তিসমূহ
কিয়ামতের দিন নরহত্যার বিচার করা হবে সর্বাগ্রে, তারপর অন্যান্য অপরাধের শাস্তি হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানবাধিকার সম্পর্কিত সর্বপ্রথম হিসেব হবে রক্তের।’ (বুখারি ৬৫৩৩; মুসলিম ১৬৭৮)
একজন মানুষকে হত্যা করলে শুধু ওই ব্যক্তিই নিহত হয় না, তার গোটা পরিবারের ওপর এর প্রভাব বিস্তার করে। সন্তানরা হয় এতিম। স্ত্রী হয় বিধবা। মা-বাবা হয় সন্তানহারা। দীর্ঘমেয়াদি এক ট্রমার মধ্য দিয়ে যায় ফ্যামিলিটি। স্বাভাবিক মৃত্যু আর খুন এক জিনিস নয়। স্বাভাবিক মৃত্যুতে মানুষের ব্রেনে একরকম সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায়; যা খুনের ঘটনায় অনুপস্থিত।
কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করাও কবিরা গুনাহ। ব্যক্তিবিশেষে অপরাধের দায় আরও বেড়ে যায়। কুরআন বলছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানুষদের মধ্য থেকে যারা ন্যায় ও ইনসাফের আদেশ করে তাদেরকে (হে নবি) তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। কাদেরই আমলসমূহ ইহকাল ও পরকালে নষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদেরই জন্য তখন আর কেউ সাহায্যকারী হবে না (আলে ইমরান : ২১-২২)।
খুনি হবে জাহান্নামি। কুরআন বলছে, ‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তার মধ্যে সে সদা সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন ও তাকে অভিশাপ দিবেন। তেমনিভাবে তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি।’ (নিসা : ৯৩)
কিয়ামতের দিনের একটি চিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘হত্যাকৃত ব্যক্তি হত্যাকারীকে সঙ্গে নিয়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। হত্যাকৃত ব্যক্তির মাথা তার হাতেই থাকবে। শিরাগুলো থেকে তখন রক্ত পড়বে। সে আল্লাহ তা‘আলাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, হে আমার প্রভু! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে হত্যাকারীকে আরশের অতি নিকটেই নিয়ে যাবে। শ্রোতারা ইবনে আব্বাসকে (রা.) হত্যাকারীর তাওবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উপরোক্ত সুরাহ নিসা’র আয়াতটি তিলাওয়াত করে বললেন, এই আয়াত রহিত হয়নি এবং পরিবর্তনও হয়নি। অতএব তার তাওবা কোনো কাজেই আসবে না।’ (তিরমিযী ৩০২৯; ইবনু মাজাহ ২৬৭০; নাসায়ী ৪৮৬৬)
মানবহত্যা এমন এক অপরাধ, যার গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করেন না। হাদিসে এসেছে, ‘প্রতিটি গুনাহ আশা করা যায় আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেবেন। তবে দুটি গুনাহ যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আর তা হচ্ছে, কোনো মানুষ কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে অথবা ইচ্ছাকৃত কেউ কোনো মুমিনকে হত্যা করলে।’ (নাসায়ী ৩৯৮৪; আহমাদ ১৬৯০৭; হা’কিম ৪/৩৫১)
অপরাধীর শাস্তি হিসেবে হত্যার বিধান
এটা কেবল শাসক কর্তৃক বাস্তবায়িত হতে পারে। শরীয়ত সম্মত তিনটি কারণের কোনো একটি কারণে শাসক গোষ্ঠীর জন্য কাউকে হত্যা করা বৈধ। বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘এমন কোনো মুসলিমকে হত্যা করা জায়েয নয় যে এ কথা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি (নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসুল। তবে তিনটি কারণের কোনো একটি কারণে তাকে হত্যা করা যেতে পারে অথবা হত্যা করা শরীয়ত সম্মত। তা হচ্ছে, সে কাউকে হত্যা করে থাকলে তাকেও হত্যা করা হবে। কোনো বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে। কেউ ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করলে এবং জামাতচ্যুত হলে।’ (বুখারি ৬৮৭৮; মুসলিম ১৬৭৬; আবূ দাউদ ৪৩৫২; তিরমিযী ১৪০২; ইব্নু মাজাহ্ ২৫৮২; ইব্নু হিববান ৪৪০৮ ইব্নু আবী শাইবাহ্, হাদীস ৩৬৪৯২; আহমাদ ৩৬২১, ৪০৬৫)
গর্ভধারণের চার মাস পর গর্ভপাত করা হত্যার শামিল
ভ্রুণ হত্যা বা গর্ভপাত এখন চাট্টিখানি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন চাইলেই এমনটি করা যায়। কোনো দায়বদ্ধতা নেই। নেই কোনো জবাবদিহিতা। আসলে কি তাই? অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে অসংখ্য বনি আদম আজ এই জঘন্য পাপে জড়িত। এটা ঠান্ডা মাথার খুনি বৈ কিছুই নয়।
হাদিসে এসেছে, ‘জনৈক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহ’র রাসুল! কোন পাপটি আল্লাহর নিকট মহাপাপ বলে বিবেচিত? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা; অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সে বলল: অতঃপর কি? তিনি বললেন, নিজ সন্তানকে হত্যা করা ভবিষ্যতে তোমার সঙ্গে খাবে বলে। সে বলল, অতঃপর কি? তিনি বললেন, নিজ প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা (বুখারি ৪৪৭৭, ৪৭৬১, ৬০০১, ৬৮১১, ৬৮৬১, ৭৫২০, ৭৫৩২; মুসলিম ৮৬)।
গর্ভধারণের চার মাসে বাচ্চা মোটামুটি আকৃতিতে চলে আসে। এরপর গর্ভপাতের অর্থই হচ্ছে বাচ্চাটাকে খুন করা। আর চার মাসের আগে খামোখা গর্ভপাত করাও শরীয়তে বৈধ নয়। শরই ওজর থাকার শর্তে তা করা যেতে পারে। তবে এতে মায়ের ভীষণ ক্ষতি হয়।
শেষ কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা হচ্ছে একটি জঘন্যতম অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির বদলায় ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ইসলামের বিধান। এ ছাড়া ঘাতকের জন্য আল্লাহর রোষানলে পড়ে ধ্বংস হওয়া এবং তার লানতের শিকার হওয়ার মতো কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। আর আখেরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। একমাত্র আল্লাহর ভয়ই পারে এ অপরাধ থেকে বাঁচাতে। পরকালীন জবাবদিহিতাই পারে মানবহত্যার মত নিকৃষ্ট পাপচার থেকে রক্ষা করতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের গোটা জাতিকে এই জঘন্য কর্ম থেকে হেফাজত করুন।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, দারুলহুদা মডেল মাদরাসা, কোদালপুর, শরীয়তপুর
০২ জুন ২০২৪, ২১:৪১